অভিশপ্ত রেলপথ - একটি পরিবারের সবাই যখন রেল দূর্ঘটনার শিকার হয়

অভিশপ্ত রেলপথ

লেখা - মোঃ বিল্লাল হোসেন

আজ থেকে প্রায় ১৭ বছর পূর্বে আমার বাবা কাজ শেষে বাড়ি ফেরার পথে রেল দূর্ঘটনার শিকার হয় এবং তাৎক্ষণিক তিনি মারা যান ( উপস্থিত থাকা জনগণ থেকে জানা যায় )। তখন তো খুব ছোট্ট ছিলাম। বয়স প্রায় ৩ বছর ছিল। বাবার অকাল চলে যাওয়ার কষ্টটা হয়তো তখন তেমন বুজতে পারি নি কিন্তু এখন বাবার না থাকার কষ্টটা খুব বুজতে পারছি। 

অভিশপ্ত রেলপথ

বাবা না থাকার কষ্টটা যে কত বেদনা ও যন্ত্রণাময় তা একমাত্র আমার মতো বাবা হারানো সন্তানেরা বুজতে পারে। বাবা চলে যাওয়ার পর আম্মু সেলাই কাজ করে যে অর্থ পেতো তা দিয়ে আমাকে ও আমার ছোট বোনকে পড়াশোনা করিয়ে বড় করে তুলে।

মায়ের কষ্ট লাঘব করার জন্য আমি পড়াশোনার পাশাপাশি পার্ট টাইম জব করতাম। যদিও বেতন খুব অল্প ছিল তবে এটাই আমার কাছে ছিল অনেক। সময় গড়াতে থাকে ছোট বোনও বিয়ের উপযুক্ত হয়ে উঠে। তাই আম্মু একজন যোগ্য পাত্র খুজছিল। যার হাতে মেয়ে দিলে অন্ততপক্ষে সুখে থাকতে পারবে। অনেক খোঁজাখুঁজির পর আম্মু পাত্রের সন্ধান পায়। খোজ নেওয়ার পর আম্মু যেমনটা চেয়েছিল ঠিক তেমনই পেয়েছি।

দেখতে শুনতেও খুব ভালো ছিল। বোনেরও পছন্দ হয়। দু'পরিবারের সম্মিলনে বিয়ের দিন ঠিক করা হয়। এক সপ্তাহ পর বোনের বিয়ে। তাই বিয়ের জন্য যা যা প্রয়োজন তা নিয়ে আসার কাজে ব্যস্ত হয়ে যাই। আব্বু থাকলে হয়তো আজ এতটা কষ্ট করতে হত না।

আগামীকাল বিয়ে। বিয়ের যা যা প্রয়োজন তা সবই কেনা-কাটা হয়ে গেছে।



আজ আদরের ছোট্ট বোনটার বিয়ে। তবুও বোনের কাছে থাকার সুযোগ হয় নি, কারণ বিয়ে বাড়ির সকল কাজ তো বড় ভাই হিসাবে আমাকে করতে হবে, তাই কাজে খুব ব্যস্ত ছিলাম। বিয়ের জন্য খাবারের ব্যবস্থা করা হয়। বরপক্ষও চলে আসে তাদের সবাইকে আদর-আপ্যায়ণ করা শেষে কাজী সাহেব ও হুজুর বিয়ের সকল কার্যক্রম শুরু করে।

বিয়ে শেষে বোনকে শশুড় বাড়িতে পাঠানোর বন্দবস্ত করা হয়। আদরের বোনকে পরের ঘরে পাঠানোর কষ্ট একজন ভাই হিসেবে অনেক বেদনাময়। কিন্তু মেয়েদের তো শশুড় বাড়ি আসল ঠিকানা। বোনকে গাড়িতে দিয়ে আসার সময় বোন একটি কথায় বলে -ভাইয়া, আম্মুকে দেখে রেখো। আম্মুর যেন কোনো কষ্ট না হয়।

বোনকে বিদায় দিয়ে যখন গাড়ি সামনে এগুতে থাকে, আদরের ছোট্ট বোনটা আবেগময় ভাবে আম্মু ও আমার দিকে চেয়ে থাকে। নিজের অজান্তে চোখ দিয়ে দু'ফোটা অশ্রু জড়ে পরে। বোনকে বিদায় দিয়ে আম্মুকে সান্ত্বনা দিচ্ছিলাম ঠিক তার ১০-১২ মিনিট পর বোনের শশুড় ফোন করে কান্না জড়িত অবস্থায় বলতেছে বাবা তুমি এখনই তোমাদের রেল-লাইনের কাছে চলে আসো।

আমি বললাম কেন ? কি হয়ছে ? ওনি বললেন, বাবা আসলে দেখতে পারবে। তুমি দ্রুত চলে আস। কিছু না বুজে মোটর-সাইকেল করে দ্রুত রেল-লাইন এর কাছে আসি। এসে দেখি একটি গাড়ি ট্রেনের সাথে ধাক্কা খেয়ে ধুমড়ে মুচড়ে পরে আছে। আর এটাই হচ্ছে আমার আদরের ছোট্ট বোনের বিয়ের গাড়ি। সামনে যেতে দেখি আদরের ছোট্ট বোনটা ও বোনের জামাই এবং আরও বেশ কয়েকজন নিস্তেজ পরে আছে রক্তাক্ত অবস্থায়। বুজলাম কারো দেহে প্রাণ নেই। মুখ দিয়ে কোনো কথা বলার সাহস ছিল না। দু'চোখ বেয়ে অঝোরে পানি জড়তে ছিল। খুব বুকফাটা কান্না করছিলাম।



যে বোনকে কিছুক্ষণ আগে হাতে মেহেদী লাগিয়ে, রঙ্গিন কাপড় পরিয়ে শশুড় বাড়িতে পাঠিয়েছি সেই বোন এখন চিরনিদ্রায় শুয়ে আছে। বোনের চলে যাওয়াটা তখন কোনো ভাবেই মেনে নিতে পারছিলাম না।

১৭ বছর আগে এই রেলপথ কেড়ে নিয়েছিল আমার বাবার জীবন আর আজ কেড়ে নিল বোন ও বোনের জামাইকে। দূর্ঘটনার কিছুক্ষণ পরেই পুলিশ উপস্থিত হয়। ময়নাতদন্তের জন্য তারা লাশগুলো নিয়ে যেতে চাইলে আমি বাধা দেই। ময়নাতদন্ত করে আর কিবা হবে। আমার বোন ও বোনের জামাই তো আর ফিরে আসবে না। এলাকার সবাই বাধা দিলে পুলিশ চলে যায়। অবশেষে বোনের লাশকে বাড়িতে নিয়ে আসি। আম্মু, বোনের এই অবস্থা দেখে কথা বলার বাকশক্তি হারিয়ে ফেলে এবং তাৎক্ষণিক জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। দ্রুত আম্মুকে ডাক্তারের কাছে নিয়া আসা হলে তারা অনেকক্ষণ পরীক্ষা নিরীক্ষা করে আমাকে একটাই কথা বলে "আপনার আম্মু আর নেই"।

নিজের কানকে বিশ্বাস করাতে পারছি না। ডাক্তার বলে যে, আপনার বোনের এই অবস্থা দেখে আপনার আম্মু এতটাই শক পায় যে, আপনার আম্মু তা সহ্য করতে পারে নি। তখন মায়ের পাশে গিয়ে এতটুকুই বলি আমাকে একা করে তোমরা সবাই চলে গেলা। দু'চোখ বেয়ে শুধু পানি পরতেছিল। মা ও বোনের চলে যাওয়ার কষ্টটা খুব বেদনাময় ছিল। বুকফাটা কান্না করছিলাম তখন। পাগলের মতো হয়ে গিয়েছিলাম।

 
ভাগ্যের পরিহাসে এই হাসি উজ্জ্বল দিনে বোন ও মাকে হারাবো এটা কখনো কল্পনা করতে পারি নি। এই অভিশপ্ত রেলপথ আমার পরিবারটাকে ধ্বংস করে দিল। জীবনে আপন বলতে আর কেউই রইলো না ।
 

ওপারে ভালো থেকো প্রিয় আব্বু,আম্মু ও আদরের ছোট বোন।

(সমাপ্ত)

Post a Comment

0 Comments